কি করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়

প্রশ্ন

  সম্মানিত মুফতি সাহেব,আমার প্রশ্ন এই যে, ইমান ভঙ্গের কারণ কয়টি ও কী কী.?

প্রশ্নকারীর নাম: মুহাম্মাদ ওলিউল্লাহ,

প্রশ্নকারীর ঠিকানা: গ্রাম লালমোহন পুর,থানা সাদাই পুর,(সিউড়ী) বীরভূম। পিন নাম্বার ৭৩১১০২

প্রকাশিত: 31-07-2024

উত্তর

ফতওয়া নং ৪৪৫

    যেসব বিষয়ের উপর ঈমান আনা জরুরী, সেগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি বিষয়কে না মানাও কুফর। যেমন, কোন লোক যদি আল্লাহ্ তা'আলাকে না মানে কিংবা আল্লাহ্ তা'আলার গুণাবলীকে অস্বীকার করে অথবা দু'তিনজন আল্লাহ্ মানে, কিংবা ফেরেস্তাগণকে অস্বীকার করে, অথবা আল্লাহ্ তা'আলার কিতাবসমূহের মধ্যে কোন কিতাবকে অস্বীকার করে, কিংবা কোন পয়গম্বর বা নবী-রাসূলকে না মানে, অথবা তাকদীর বা নিয়তিকে অস্বীকার করে, কিংবা কিয়ামত দিবসকে না মানে অথবা আল্লাহ্ তা'আলার অকাট্য আহকাম বা নির্দেশাবলী থেকে কোন নির্দেশকে অস্বীকার করে অথবা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত কোন সংবাদকে মিথ্যা মনে করে, তবে এ সব অবস্থায় সে কাফের হয়ে যাবে। তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। ( তালিমুল ইসলাম) 

যে সব বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস রাখাকে ঈমান বলা হয়, প্রকাশ্যে তার কোন কিছুকে মুখে অস্বীকার করা বা তার প্রতি অন্তরে বিশ্বাস না রাখা হল কুফর।

কতিপয় কুফরী ও তার বিবরণ
* কুরআন-হাদীছের অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত কোন বিষয় অস্বীকার করা যেমনঃ নামায রোযা ফরয হওয়াকে অস্বীকার করা, নামাযের সংখ্যা, রাকআতের সংখ্যা, রুকু সাজদার অবস্থা, আযান, যাকাত, হজ্জ, ইত্যাদি বিষয়-এর কোনটি অস্বীকার করা কুফরী।
* কোন মুসলমানকে কাফের আখ্যায়িত করা কুফরী।

* কুরআন-হাদীছের অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত কোন বিষয়ের এমন ব্যাখ্যা দেয়া, যা কুরআন ও হাদীছের স্পষ্ট বিবরণের খেলাফ-এটাও কুফরী।

* কুষ্ণ ও ভিন্ন ধর্মের কোন শি'আর বা ধর্মীয় বিশেষ নিদর্শন গ্রহণ করা কুফরী, যেমন হিন্দুদের ন্যায় পৈতা গলায় দেয়া, খৃষ্টানদের ক্রুশ গলায় ঝুলানো ইত্যাদি।

* কুরআনের কোন আয়াতকে অস্বীকার করা বা তার কোন নির্দেশ সম্পর্কে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা কুফরী।

* কুরআন শরীফকে নাপাক স্থানে ও ময়লা আবর্জনার মধ্যে নিক্ষেপ করা কুফরী।

* ইবাদত ও তাযীমের নিয়তে কবরকে চুমু দেয়া কুফরী। ইবাদতের নিয়ত ছাড়া চুমু দেয়া গোনাহে কবীরা।

* দ্বীন ও ধর্মের কোন বিষয় নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা কুফরী। এ জন্যেই নামায রোযা নিয়ে উপহাস করা কুফরী, ইসলামের পর্দা ব্যবস্থাকে তিরস্কার করা বা উপহাস করা কুফরী, দাড়ি টুপি পাগড়ী নিয়ে উপহাস করা
কুফরী ইত্যাদি।

* আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কোন হুকুমকে খারাপ মনে করা এবং তার দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করা কুফরী।

* ফেরেস্তাদের সম্পর্কে বিদ্বেষভাব পোষণ করা বা তাদের সম্পর্কে কটুক্তি করা কুফরী।

* হারামকে হালাল মনে করা এবং হালালকে হারাম মনে করা কুফরী।

* কারও মৃত্যুতে আল্লাহ্র উপর অভিযোগ আনা, আল্লাহকে জালেম সাব্যস্ত করা কুফরী।

* কাউকে কুফরী শিক্ষা দেয়া কুফরী।

* হারাম বস্তু পানাহারের সময় বিসমিল্লাহ বলা, যেনায় লিপ্ত হওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলা কুফরী। 

* দ্বীনী ইল্মের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন ও অবমাননাকর বক্তব্য প্রদান করা কুফরী।

* হক্কানী উলামায়ে কেরামকে দ্বীনী ইলমের ধারক বাহক হওয়ার দরুণ গালি দেয়া বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। এটাও কুফরী।


* কেউ প্রকাশ্যে কোন গোনাহ করে যদি বলে যে, আমি এর জন্য গর্বিত তাহলে সেটা কুফরী।

* আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ)-এর অবমাননা করা, আল্লাহ ও নবীকে গালি দেয়া এবং তাঁদের শানে বেয়াদবী করা কুফরী।

* যে যাদুর মধ্যে ঈমানের পরিপন্থী কুফর ও শিরকের কথাবার্তা বা কাজকর্ম থাকে তা কুফরী।

ঈমান পরিপন্থী কিছু আধুনিক ধ্যান-ধারণা

* জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস মানা, জনগণকে আইনের উৎস মানা ঈমান পরিপন্থী। কেননা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসে আল্লাহকেই সর্বময় ক্ষমতার উৎস স্বীকার করা হয় এবং বিধান দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর।

* প্রচলিত গণতন্ত্রে জনগণকেই সকল ক্ষমতার উৎস এবং জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে আইন বা বিধানের অথরিটি বলে স্বীকার করা হয়, তাই প্রচলিত গণতন্ত্র-এর ধারণা ঈমান আকীদার পরিপন্থী।

* সমাজতন্ত্রে নিখিল বিশ্বের কোন সৃষ্টিকর্তা বা খোদা আছে বলে স্বীকার করা হয় না, তাই নাস্তিকতা নির্ভর এই সমাজতন্ত্রের মতবাদে বিশ্বাস করা ঈমান আকীদা পরিপন্থী।

* গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্রমন্ত্রকে মুক্তির পথ মনে করা এবং একথা বলা যে, ইসলাম সেকেলে মতবাদ, এর দ্বারা বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের

এই যুগে উন্নতি অগ্রগতি সম্ভব নয়- এটা কুফরী।

 * "ধর্ম নিরপেক্ষতা"-এর অর্থ যদি হয় কোন ধর্মে না থাকা, কোন ধর্মের পক্ষ অবলম্বন না করা, কোন ধর্মকে সমর্থন দিতে না পারা, তাহলে এটা কুফরী মতবাদ। কেননা ইসলাম ধর্মে থাকতেই হবে, ইসলামের পক্ষ অবলম্বন করতেই হবে, ইসলামী কার্যক্রমকে সমর্থন দিতেই হবে। আর যদি ধর্মনরিপেক্ষতার অর্থ হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত না করা, তাহলে সে ধারণাও ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী। কেননা, ইসলামী আকীদা বিশ্বাসে ক্ষমতা ও সামর্থ্য থাকলে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা ফরয। আর কোন ফরযকে আস্বীকার করা কুফরী। যদি ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ শুধু এতটুকু হয় যে, সকল ধর্মাবলম্বীরা নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারবে, জোর জবরদস্তী কাউকে অন্য ধর্মে প্রবেশ করানো যাবে না, তাহলে এতটুকু ধারণা ইসলাম পরিপন্থী হবে না।

* ডারউইন-এর বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করা কুফরী অর্থাৎ, একথা বিশ্বাস করা যে, বিবর্তন অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হতে হতে এক পর্যায়ে বানর থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। এরূপ বিশ্বাস ইসলাম ও ঈমান পরিপন্থী। ইসলামী আকীদা বিশ্বাসে আল্লাহ তা'আলা নিজ হাতে সর্ব প্রথম হযরত আদম ( আঃ ) কে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর থেকেই মনুষ্য জাতির বিস্তৃতি ঘটেছে। 

* ইসলাম মসজিদের ভিতর সীমাবদ্ধ থাকবে, ইসলাম ব্যক্তিগত ব্যাপার, ব্যক্তিগত জীবনে এটাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে এটাকে টেনে আনা যাবে না- এরূপ বিশ্বাস করা কুফ্রী। কেননা, এভাবে ইসলামের ব্যাপকতাকে অস্বীকার করা হয়। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী কুরআন-হাদীছে তথা ইসলামে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্টীয় যাবতীয়

ক্ষেত্রের সকল বিষয়ে শাশ্বত সুন্দর দিক নির্দেশনা রয়েছে।

* নামায রোযা, হজ্জ, যাকাত, পর্দা করা ইত্যাদি ফরয সমূহকে ফরয তথা অত্যাবশ্যকীয় জরূরী মনে না করা এবং গান, বাদ্য, সুদ, ঘুষ ইত্যাদি হারাম সমূহকে হারাম মনে না করা এবং এগুলোকে মৌলভীদের বাড়াবাড়ি বলে আখ্যায়িত করা কুফরী। কেননা কোন ফরযকে ফরয বলে অস্বীকার করা বা কোন হারামকে জায়েয মনে করা কুফরী।

* টুপি, দাড়ি, পাগড়ী, মসজিদ, মাদ্রাসা, আলেম মৌলভী ইত্যাদিকে তুচ্ছ জ্ঞান করা, এগুলোকে হেয় দৃষ্টিতে দেখা, এগুলো নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা মারাৱক গোমরাহী। ইসলামের কোন বিষয়- তা যত সামান্যই হোক- তা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।

* আধুনিক কালের নব্য শিক্ষিতদের কেউ কেউ মনে করেন যে, কেবল মাত্র ইসলমই নয়- হিন্দু, খৃষ্টান, ইয়াহুদী, বৌদ্ধ নির্বিশেষে যে কোন ধর্মে থেকে মানবতা, মানব সেবা পরোপকার প্রভৃতি ভাল কাজ করলে পরকালে মুক্তি হবে। এরূপ বিশ্বাস করা কুফরী। একমাত্র ইসলাম ধর্ম অনুসরণের মধ্যেই পরকালীন মুক্তি নিহিত- একথায় বিশ্বাস রাখা ঈমানের জন্য জরুরী।

বিঃ দ্রঃ অত্র লেখনীতে যেসব বিষয়কে কুফরী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, কারও মধ্যে তা পরিলক্ষিত হলেই তাকে কাফের বলে ফতওয়া দিয়ে দেয়া যাবে না। কেননা কুফরের মধ্যে বিভিন্ন স্তর রয়েছে। যদিও সব স্তরের কুফরী গোমরাহী এবং যার মধ্যে তা পাওয়া যাবে সে পথভ্রষ্ট, গোমরাহ এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আত বহির্ভূত, তবে কুক্রের কোন্ স্তর পাওয়া গেলে কাউকে কাফের বলে ফতওয়া দেয়া যায় তা বিজ্ঞ উলামা ও মুক্তীগণই নির্ণয় করতে পারেন। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের পক্ষে বিজ্ঞ উলামা ও মুফতীগনের স্মরণাপন্ন হওয়া ব্যতীত নিজেদের থেকে কোন ফতওয়া বা সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা সমীচীন হবে না।

 কাউকে কাফের আখ্যায়িত করার জরুরী কয়েকটি মূলনীতি।
১. যখন কেউ প্রকৃতই কাফের হয়ে যায়, তখন তাকে কাফের বলে ফতওয়া দিয়ে দেয়া মুফতীদের কর্তব্য, যাতে অন্য মুসলমান তার আকীদা বিশ্বাসের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে মুফতীদের কিছু লোকের এ কথার ভয় করা উচিত হবে না যে, মৌলভীরা শুধু ফতওয়াবাজী করে বেড়ায় বা নিজেদের মধ্যে কাদা ছুড়াছুড়ি করে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে হক কথা বলা কাদা ছুড়াছুড়ি নয় বরং উম্মতকে হেফাজত করার জন্য এটা বলে দেয়াই জরুরী।

২. যদি কেউ প্রকৃতঃই কাফের না হয়ে যায়, তাহলে তাকে কাফের আখ্যায়িত করা মহাপাপ। এতে এরূপ ফতওয়া প্রদানকারী স্বয়ং নিজেই কাফের হয়ে যাবে। কাজেই কাফের ফতওয়া প্রদানের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে-এ ব্যাপারে তাড়াহুড়া সংগত নয়।
৩. কোন মুসলমানের কোন কথা বা কাজ কুফর কি-না- এ ব্যাপারে উভয় দিকের সম্ভাবনা থাকলে তাকে সেই কথা বা কাজের ভিত্তিতে কাফের বলে ফতওয়া দেয়া যাবে না, এমন কি কুফরের দিকটার সম্ভাবনা বেশী থাকলেও এমনকি সেটা কুফর হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯ ভাগ আর কুফর না হওয়ার সম্ভাবনা ১ ভাগ হলেও। তবে হ্যাঁ একটি কথা বা একটি কাজও যদি এমন পাওয়া যায় যা নিশ্চিতই কুফরী, তাহলে তার কারণে তাকে কাফের, আখ্যায়িত করা হবে। (ইসলামী যিন্দেগী ৯১–৯২ ও ১১২)

 

 

 

                 স্বাক্ষর

মুফতী সাইফুল ইসলাম কাসিমী
ফতওয়া বিভাগ,জামিয়া নু'মানিয়া।
০৩ সফর, ১৪৪৬ হিজরী (09/08/2024)


উত্তর দেখা হয়েছে : 219